বেপরোয়া নগরায়ণে তপ্ত কলকাতা, হুমকিতে বাংলাদেশ – DW (বাংলা)

কলকাতা নিউজ

ফলে বিপদের মুখে ‘সিটি অফ জয়’৷ কলকাতার তাপমাত্রার এমন বৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে বিশ্বের একমাত্র ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনেও৷ ইতিমধ্যে সেখানকার সমুদ্রের জলস্তর বাড়ছে৷

গত ৭০ বছর ধরে জলবায়ু পরিবর্তন পর্যবেক্ষণের পর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য দিয়েছে জাতিসংঘ৷ আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশের এমন বিপর্যয়ের মাশুল দিতে হতে পারে  বাংলাদেশকেও৷

রাষ্ট্রসংঘের অধীন ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) বিশ্বের ২০টি শহর ও এলাকার উপর সমীক্ষা চালিয়েছে৷গত সাত দশকের জলবায়ু পর্যবেক্ষণের পর এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়৷ হিসেব অনুযায়ী, ১৯৫০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বিশ্বের নিরিখে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে কলকাতা মহানগরের৷ এসময়ে শহরটির তাপমাত্রা বেড়েছে ২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস৷ কলকাতার পরে রয়েছে ইরানের রাজধানী তেহরান৷ সেখানে ভূপৃষ্ঠের উপরে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বেড়েছে ২.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস৷ তৃতীয় অবস্থানে আছে রাশিয়ার রাজধানী মস্কো৷ সেখানে এই বৃদ্ধি ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস৷

তাপমাত্রা বাড়ছে কেন?

সমীক্ষা অনুযায়ী, কলকাতায় এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ৮০ শতাংশ দায়ী লাগামছাড়া নগরায়ণ৷ ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের পাশাপাশি শিল্পোন্নত দেশের উপর সমীক্ষা চালানো হয়েছে৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, আর্জেন্টিনা থেকে মিশর কিংবা চীন, জাপানের বিভিন্ন শহর ও এলাকার জলবায়ুর উপর গবেষণা চালিয়েছে রাষ্ট্রসংঘের প্যানেল৷

প্রতিবেদন অনুযায়ী, অন্য অনেক উন্নত দেশের চেয়েও কলকাতা শহরকে নগরায়ণের খেসারত বেশি দিতে হচ্ছে৷৷

ভূপৃষ্ঠের বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বাড়ার একাধিক কারণ দেখানো হয়েছে প্রতিবেদনে৷ বলা হচ্ছে, উঁচু উঁচু বাড়ি কাছাকাছি থাকায় বায়ুমণ্ডল তাপ মুক্ত হতে পারছে না, আটকে থাকছে ভূপৃষ্ঠের আশপাশে৷ তাছাড়া বহুতল নির্মাণে ব্যবহৃত সামগ্রী তাপমাত্রা ধরে রাখছে৷

পরিবেশবিদ্যার গবেষক ও অধ্যাপক ডঃ তড়িৎ রায়চৌধুরি বলেন, ‘‘এই তাপমাত্রা মানুষের কার্যকলাপের ফলশ্রুতি৷ এই অপরিকল্পিত শহরে অল্প পরিসরে বহু মানুষ রাস্তাঘাটে জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে, অটোমোবাইল বা বিদ্যুতের ব্যবহার করে প্রচুর তাপ উৎপাদন করে৷’’

অর্থাৎ সাধারণ মানুষের গতিবিধির ফলে তাপ বেরিয়ে মিশছে বাতাসে৷ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞানের (উপকূল এলাকা) অধিকর্তা অধ্যাপক তুহিন ঘোষ বলেন, ‘‘শহরতলির তুলনায় শহরে তাপমাত্রা অনেক বেশি৷ যেহেতু কলকাতায় শক্তির ব্যবহার বেশি হয়, সবুজও কম আর দূষণও অত্যাধিক সে কারণে কলকাতার উপরেএকটা কুয়াশার স্তর থাকে৷ আর তাই তাপমাত্রা ভূপৃষ্ঠ থেকে বিকিরিত হতে পারে না৷ শহরতলি এলাকায় যে তাপমাত্রা তৈরি হা তা বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়৷ কলকাতায় তা হচ্ছে না৷ ফলে তৈরি হচ্ছে হিট আইল্যান্ড৷’’

উষ্ণায়নের ফল কী

এমন অবস্থা চলতে থাকলে চলতি শতকের শেষে কলকাতার পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়৷ অনুমান করা হচ্ছে, বছরে ১৫০ দিন অর্থাৎ পাঁচ মাস শহরের তাপমাত্রা থাকবে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে৷

এদিকে এমন উষ্ণায়নের ফলে শুধু কলকাতা নয়, বিপন্ন হয়ে পড়ছে সুন্দরবনও৷ জাতিসংঘের প্রতিবিদেন প্রস্তুতকারকদের একজন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির অধ্যাপক সইফুল ইসলামের মতে, পরিস্থিতি এখনই নিয়ন্ত্রণে না আনলে সুন্দরবন এলাকা আরও দুর্যোগের মধ্যে পড়বে৷ যার ফল কলকাতার পাশাপাশি ভুগতে হবে বাংলাদেশের খুলনা অঞ্চলকেও৷

পশ্চিমবঙ্গের উপকূল অঞ্চলে সমুদ্রের জলস্তর ইতিমধ্যেই বেড়েছে৷ এভাবে তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে ভূমিক্ষয় হবে, বাড়বে প্লাবনের প্রবণতা৷ রিপোর্টে আশঙ্কা করা হয়, এই শতকের শেষে সুন্দরবন লাগোয়া সমুদ্রের জলস্তর ৬০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে৷ বার বার হানা দেবে ঘূর্ণিঝড়৷

অধ্যাপক তুহিন ঘোষের বক্তব্য, ‘‘অপরিশোধিত বর্জ্য ফেলার ফলে নদীর তাপমাত্রা বাড়ে৷ তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মাছ ও অন্যান্য প্রাণী, পরোক্ষভাবে ম্যানগ্রোভ৷ বর্জ্য সুন্দরবনের নদী দিয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে৷ এতে সমুদ্রের তাপমাত্রা বাড়ছে, ফলে আঞ্চলিকভাবে নিম্নচাপের সৃষ্টি হচ্ছে৷’’

সংকটে জীববৈচিত্র্য

তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় কলকাতায় প্রাণীদের বাসস্থান সঙ্কটে পড়ছে৷ ফলে জীববৈচিত্র্যে প্রভাব পড়ছে৷

পশ্চিমবঙ্গ জীববৈচিত্র্য পর্ষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক অশোককান্তি সান্যাল বলেন, ‘‘জলাশয় ও মাটিতে বসবাসকারী কীট-পতঙ্গগুলো সমস্যায় পড়বে৷ মানুষের শরীরের ওপর প্রভাব পড়বে বেশি৷’’

কলকাতায় এখন চার-পাঁচ শতাংশ সবুজ এলাকা৷ সেটা আগে ছয়-সাত শাতংশ ছিল৷ সবুজ এলাকা এভাবে কমে যাওয়ার ফলে ‘হিট আইল্যান্ড’ তৈরির সম্ভাবনা বাড়ছে৷

এমনটাই মনে করেন কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ্যার প্রাক্তন অধ্যাপক সুভাষ চন্দ্র সাঁতরা৷ তিনি বলেন, ‘‘কংক্রিটের রাজত্বে তাপমাত্রা যদি এভাবেই বাড়তে থাকে, তাহলে বড়সড় পরিবর্তন চোখে পড়বে৷ পরিযায়ীরা এমনিতেই আসা কমিয়ে দিয়েছে৷ বাসস্থানের অভাব এবং তাপমাত্রা দুটোর কারণে কমে যাচ্ছে ছোট ছোট পাখিও৷’’

Source: https://www.dw.com/bn/%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%AA%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A7%9F%E0%A6%BE-%E0%A6%A8%E0%A6%97%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A7%9F%E0%A6%A3%E0%A7%87-%E0%A6%A4%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%A4-%E0%A6%95%E0%A6%B2%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A6%BE-%E0%A6%B9%E0%A7%81%E0%A6%AE%E0%A6%95%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6/a-59084873