বঙ্গবন্ধুর কলকাতা জীবন – Dhakatimes24

কলকাতা নিউজ

বঙ্গবন্ধু তখন পরিপূর্ণ যুবক। বছর চারেক বিলম্বে এন্ট্রাস পাস করেছেন। ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়েছেন কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে। সময়টি হলো বিংশ শতকের প্রথমার্ধ এবং শহরটি কলকাতা। এই কলকাতা তখন বিপুল ভারতবর্ষের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর। শুধু ভারতবর্ষের মধ্যে বললে ঠিক হবে না, বরং বলা যায় ব্রিটিশশাসিত গোটা বিশ্বের মধ্যে লন্ডনের মতো কলকাতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শহর হয়ে উঠেছে। কলকাতা শহরের বিকাশের এই যাত্রা শুরু হয়েছিল ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধ থেকেই। মোটা দাগে বলা যায়, এই যাত্রা শুরু হয় ১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার শুভলগ্ন থেকে। কিংবা ১৮১৪ সালে কলকাতায় রামমোহন রায়ের স্থায়ীভাবে বসবাসের সময় থেকে। বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে, সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে, দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধের উত্থানের ক্ষেত্রে, রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে এতসব বিপ্লব সাধিত হয়েছে এবং এতসব আলোড়ন-বিলোড়ন এই শহরকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয়েছে, তার ইতিহাস লেখা আছে অসংখ্য গ্রন্থে ও পত্রপত্রিকায়।

১৬৯০ সাল। জব চার্নক নামক একজন বেনিয়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য পরিচালনার জন্য বসতি স্থাপনের জায়গা হিসেবে মুঘল বাদশার কাছ থেকে সুতানুটি, ডিহি কলকাতা ও গোবিন্দপুর নামে তিনটি গ্রামের অধিকার লাভ করেছিলেন। এরপর কোম্পানি কলকাতায় একটি দুর্গবেষ্টিত বাণিজ্যকুঠি গড়ে তোলে। সুকুমার সেন ‘শব্দবিদ্যার আঁচড়ে’ নামক একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, “কলকাতা শহরের পত্তন হয়েছিল বেচাকেনার জন্য। শহরের এই মূল চরিত্র অবলম্বন করেই আড়াই শ-তিন শ বছর ধরে শহরটি ফুলে-ফেঁপে উঠেছে […]।”১ স্পষ্টতই যে, কলকাতা শহরের পত্তন হয়েছিল ব্যবসার জন্য। আর ব্যবসা মানে টাকা এবং টাকা মানে স্থাপনা, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, হাট-বাজার, শিক্ষা-দীক্ষা, রাজনীতি, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, মিছিল-মিটিং-সভা, আন্দোলন, বিপ্লব-বিদ্রোহ। অষ্টাদশ শতক থেকে ভারত উপমহাদেশে কলকাতার অর্থনৈতিক বিকাশের সঙ্গে বিকশিত হতে থাকে সমাজ-সংস্কৃতি উন্নয়নের উপরিউক্ত উপকরণসমূহ।

image

অর্থনৈতিক বেনিয়াদের পথ ধরে ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে বাংলার নবজাগরণের কেন্দ্রস্থল ছিল কলকাতা শহর। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে এবং কারো কারো মতে গোটা উনিশ শতকজুড়েই বাংলায় বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ ঘটে, যাকে ইউরোপীয় ধারার নবজাগরণ বলা যায়। তারা বিশ্বাস করেন, ব্রিটিশ শাসনের প্রভাবে বাংলার শিক্ষিত সম্প্রদায় জীবনবোধ ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে নানা বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু হয়ে ওঠে এবং প্রতিষ্ঠিত জ্ঞান, মূল্যবোধ, সমাজ-সংগঠন, বিশ্বাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে প্রশ্ন তুলতে শেখে। বলা হয়, এ নতুন দৃষ্টিভঙ্গি বাংলার সমসাময়িক জীবনধারাকে বস্তুতান্ত্রিকভাবে প্রভাবিত করে। বিভিন্ন প্রতিবাদমূলক আন্দোলন, নানা সংগঠন, সমাজ ও সমিতি গঠন, ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন, নতুন শৈলী ও জীবনজিজ্ঞাসার বাংলা সাহিত্যের আবির্ভাব, রাজনৈতিক চেতনা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ইত্যাকার ক্ষেত্রে জাগরণ ঘটে এ সময়ে। নবজাগরণ তত্ত্বের প্রবক্তাদের মতে, এসব বিষয়ের মূলে ছিল ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে ইউরোপীয় দর্শন, ইতিহাস, বিজ্ঞান ও সাহিত্য সম্পর্কে নতুন জ্ঞান। নবজাগরণ বাংলার হিন্দু সমাজের উঁচু স্তরের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত সামান্য অংশকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রভাবিত করলেও শেষাবধি তা শিক্ষিত মুসলিম সমাজ এবং অন্যদের মাঝেও প্রসারিত হয় এবং নবজাগরণ ছড়িয়ে যায় ওই শতকের শেষভাগে উপমহাদেশের অন্য সব অংশেও।

এই সময় ব্রিটিশ ও ভারতীয় সংস্কৃতির মিশ্রণে শহুরে বাঙালিদের মধ্যে এক নব্য বাবু শ্রেণির উদ্ভব ঘটেছিল। এই বাবুরা ছিলেন সাধারণত উচ্চবর্ণীয় হিন্দু, ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ও সংবাদপত্র পাঠক। পেশাগতভাবে এঁরা ছিলেন জমিদার, সরকারি কর্মচারী বা শিক্ষক। যাদের পাণ্ডিত্য, মেধা ও শ্রমে নবজাগরণ সংগঠিত হয়েছিল তাঁরা হলেন রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩), হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১), রামতনু লাহিড়ী (১৮১৩-১৮৯৮), মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪), রামকৃষ্ণ পরমহংস (১৮৩৬-১৮৮৬), কেশবচন্দ্র সেন (১৮৩৮-১৮৮৪), স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২) প্রমুখ ব্যক্তি। নবজাগরণে নিবেদিত মনীষীবর্গ যেসব পাশ্চাত্য চিন্তাধারায় উজ্জীবিত হয়েছিলেন তা ছিল যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ, উপযোগবাদ, বিজ্ঞানবাদ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, দৃষ্টবাদ, ডারউইনবাদ, সমাজবাদ ও জাতীয়তাবাদ। পুনরুজ্জীবিত বাংলার চিন্তাবিদগণ ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬), আইজ্যাক নিউটন (১৬৪২-১৭২৭), জেরেমি বেনথাম (১৭৪৮-১৮৩২), টমাস পেইন (১৭৩৭-১৮০৯), অগুস্ত কোঁত (১৭৯৮-১৮৫৭), চার্লস ডারউইন (১৮০৯-৮২) ও জন স্টুয়ার্ট মিল-এর (১৬০৬-৭৩) মতো পাশ্চাত্যের আরও অনেক আধুনিক চিন্তাবিদ ও মনীষীর গুণগ্রাহী ও অনুসারী হয়ে ওঠেন। এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল (প্রতিষ্ঠিত, ১৭৮৪), শ্রীরামপুরের ব্যাপটিস্ট মিশন (১৮০০), ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ (১৮০০), হিন্দু কলেজ (১৮১৭), ক্যালকাটা স্কুল-বুক সোসাইটি (১৮১৭), কলকাতা মেডিকেল কলেজ (১৮৩৫), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের (১৮৫৭) মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলার নবজাগরণে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখে। এমন একটি শহরে বঙ্গবন্ধুর বিকাশ প্রতিষ্ঠার ইতিবৃত্ত রচিত হয় এবং যৌবনের সবচেয়ে সৃষ্টিশীল অধ্যায় ও প্রেরণার সময়টি তিনি অতিবাহিত করেন বিপুল এই শহরের লোকারণ্যে। যুবক শেখ মুজিবের চেতনার সমৃদ্ধি ও পরিপুষ্টিদানে এই শহরের প্রায় দুই শ’ বছরের নবজাগরণের বিচিত্র মতাদর্শ, মূল্যবোধ, দর্শন, বহুত্ববাদ কতভাবে যে ভূমিকা রেখেছে, কতভাবে যে তাঁর চেতন-অবচেতনের জগৎকে বিপুল করে তুলেছে, তার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই।

দুই.

১৮৮৩ সালে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৪৮-১৯২৫) জাতীয় সম্মেলনের আয়োজন করেন। এটিই ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতে প্রথম রাজনৈতিক সম্মেলন। এরপর ধীরে ধীরে কলকাতা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। বিশেষত বিপ্লবী সংগঠনগুলোর অন্যতম প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয় কলকাতা শহর। রাজনীতিসচেতন এবং জাতীয়তাবাদী চিন্তায় উদ্বুদ্ধকারী সংগঠনগুলোর জন্মও হয়েছিল বাংলায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত ‘ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন’। ১৮৮৫ থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত জাতীয় কংগ্রেসের প্রধান রাজনৈতিক দাবিগুলো মূলত ছিল ‘ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের’ দাবিসমূহের মার্জিত রূপ। নেহরু বাঙালির এই ভূমিকা সম্পর্কে তাঁর আত্মজীবনী ভারত সন্ধানে লিখেছেন যে, বাংলাদেশের নেতারা সমগ্র রাজনৈতিক ভারতের নেতা রূপে প্রতিভাত হয়েছিলেন। বড় লাট ডাফ্রিনের ইচ্ছায় ভারতীয় সিভিল সার্ভিস থেকে অবসরপ্রাপ্ত অ্যালন অক্টোভিয়ান হিউম কংগ্রেস গঠনের পরিকল্পনা করেন। ভারতীয় জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দ মোহন বসু প্রমুখ নেতাদের সহযোগিতায় হিউম কংগ্রেস গঠনে সফল হন। ১৮৮৫ সালের ২৫-এ ডিসেম্বর বোম্বাই শহরে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি ছিলেন কলকাতার বিখ্যাত ব্যারিস্টার উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।

১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস গঠিত হলেও বেশিরভাগ মুসলিম নেতা এতে অংশগ্রহণ করেননি। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের ঘোষণার ফলে অবহেলিত পশ্চাৎপদ বাংলার মুসলমানদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়। কিন্তু কংগ্রেস এবং হিন্দু নেতৃবৃন্দ বঙ্গভঙ্গের চরম বিরোধিতা শুরু করেন। ফলে মুসলমানদের মধ্যে তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং তারা কংগ্রেস থেকে আরও দূরে সরে যায়। হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। এই অবস্থায় মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধভাবে দাবি আদায়ের জন্য একটি সংগঠন জরুরি ছিল। এসব কারণে, নিজেদের স্বার্থের প্রয়োজনে মুসলমানদের মধ্যে রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের আগ্রহ দেখা দেয়। ১৯০৬ সালের ১ অক্টোবর আগা খানের নেতৃত্বে ৩৫ সদস্যবিশিষ্ট মুসলিম প্রতিনিধিদল সিমলায় বড় লাট লর্ড মিন্টোর সঙ্গে দেখা করেন। সেখানে বড় লাটের কাছে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষাসংক্রান্ত একটি দাবিনামা পেশ করা হয়। এই সাক্ষাৎকারের পর মুসলমান নেতৃবৃন্দ তাঁদের দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল গঠন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় ‘নিখিল ভারত মুসলিম এডুকেশন কনফারেন্স’। সম্মেলন শেষে নওয়াব ভিখারুল মুলক্-এর সভাপতিত্বে মুসলিম নেতাদের উপস্থিতিতে একটি রাজনৈতিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় নবাব সলিমুল্লাহ ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রস্তাবটি সমর্থন করেন হাকিম আজমল খান, জাফর আলী খান, মুহম্মদ আলী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। এই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার শাহবাগে গঠিত হয় ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’ নামে একটি রাজনৈতিক দল। এভাবে মুসলমানদের নিজস্ব রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়, যার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল: এক. ভারতের মুসলমানদের মধ্যে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্যবোধ সৃষ্টি করা। সরকারের কোনো ব্যবস্থা সম্পর্কে তাদের মধ্যে ভুল ধারণা জন্মালে তা দূর করা। দুই. ভারতের মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার ও স্বার্থ রক্ষা করা। মুসলমানদের আশা-আকাক্সক্ষা সরকারের কাছে তুলে ধরা। তিন. এসব উদ্দেশ্য ব্যাহত না করে ভারতের অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা।

মুসলিম লীগ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন নবাব সলিমুল্লাহ, সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, জাফর আলী খান, হাকিম আজমল খান ও মুহম্মদ আলী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের প্রথম সভাপতি ছিলেন আগা খান। রাজনীতির এই বিপুল আলোড়নের মধ্যে বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনাদর্শ ও রাজনৈতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার তীর্থভূমি কলকাতায় আবির্ভূত হন। এবং মুসলিম লীগের পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত হন। পাশাপাশি অর্থনীতি, রাজনীতি, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যচর্চার তীর্থভূমি কলকাতা শেখ মুজিবুর রহমানের মনের গড়ন তৈরিতে কতভাবে যে ভূমিকা রেখেছে তার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ ও মূল্যবোধের মধ্যে, তাঁর জীবনবোধ ও জীবনাদর্শের মধ্যে, জীবন সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিকোণ ও দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে এবং সর্বোপরি রাষ্ট্র পরিচালনায় তাঁর আদর্শ ও দর্শনের মধ্যে।

তিন.

অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, “শেখ বোরহানউদ্দিন নামে এক ধার্মিক পুরুষ এই বংশের গোড়াপত্তন করেছেন বহুদিন পূর্বে। শেখ বংশের যে একদিন সুদিন ছিল তার প্রমাণস্বরূপ মোগল আমলের ছোট ছোট ইটের দ্বারা তৈরি চকমিলান দালানগুলো আজও আমাদের বাড়ির শ্রীবৃদ্ধি করে আছে।”২ আর বঙ্গবন্ধুতনয়া শেখ হাসিনা লিখেছেন, “আমাদের পূর্ব-পুরুষরা টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জমিজমা ক্রয় করে বসতির জন্য কলকাতা থেকে কারিগর ও মিস্ত্রি এনে দালান বাড়ি তৈরি করেন যা সমাপ্ত হয় ১৮৫৪ সালে।”৩ প্রায় আড়াই শ বছর পূর্বে দারিদ্র্যপীড়িত পূর্ববঙ্গের যে বাড়ির চার ভিটায় চারটি দালান থাকে সেই বাড়ির আর্থিক অবস্থা অসাধারণ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। পরিবারটি এই বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছিল শুধু কৃষিকাজ করে নয়। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “জমিদারির সাথে সাথে তাদের বিরাট ব্যবসাও ছিল।”৪ আর এই ব্যবসা গড়ে উঠেছিল কলকাতা বন্দরকে কেন্দ্র করে।৫ বিপুল নৌবহর আর অসংখ্য মাঝিমাল্লা নিয়ে কলকাতায় এই ব্যবসা পরিচালনা করতেন শেখ কুদরতউল্লাহ। কিন্তু বিচিত্র ঘটনা ও অঘটনের ভেতর দিয়ে পরিচালিত হতে হতে এক সময় শেখ বংশ সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “আমার দাদার চাচা এবং রেণুর দাদার বাবা কলকাতা থেকে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে চলে আসেন বাড়িতে। কলকাতার সম্পত্তি শেষ হয়ে যায়।”৬ সুতরাং লক্ষ করা যায় যে, কলকাতার সঙ্গে শেখ বংশের পরিচয় নতুন কোনো ঘটনা নয়। বরং পুরুষানুক্রমে এই পরিবারটি কলকাতর উত্থানের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল। বঙ্গবন্ধুর কলকাতায় গমন সেই উত্তর সাধনারই অনিবার্য নিয়তি। কিন্তু প্রথম তাঁর কলকাতায় গমন কোনো সুখকর বিষয় ছিল না। ১৯৩৪ সালে যখন তিনি সপ্তম শ্রেণির ছাত্র তখন হঠাৎ বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হন এবং তাঁর হার্ট দুর্বল হয়ে পড়ে। চিকিৎসার জন্য তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতায় এবং ডাক্তার শিবপদ ভট্টাচার্য ও এ কে রায় চৌধুরীর মতো বড় বড় ডাক্তার দেখানো হয়। এভাবেই দুই বছর তাঁর চিকিৎসা চলে। লক্ষণীয় যে, পূর্ববঙ্গের সাধারণ মানুষ যখন চিকিৎসার জন্য হাতুড়ে ডাক্তার, গ্রামীণ চিকিৎসক, ঝাড়ফুঁক ইত্যাদির ওপর নির্ভরশীল তখন শেখ মুজিবুর রহমানের চিকিৎসা চলে কলকাতায়, বিখ্যাত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে। বেরিবেরি রোগের চিকিৎসা শেষ হতে না হতেই ১৯৩৬ সালে তিনি চোখের রোগ গ্লুকোমায় আক্রান্ত হন। আবার তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতায়। এবার তিনি চিকিৎসা নেন সে সময়ের বিখ্যাত চোখের ডাক্তার টি. এম আহমেদের কাছে। কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাঁর চোখের অপারেশন হয়। তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন; কিন্তু পড়াশোনা করার মতো অবস্থা ছিল না। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন:

চোখের চিকিৎসার পর মাদারীপুরে ফিরে এলাম, কোনো কাজ নেই। লেখাপড়া নেই, খেলাধুলা নেই, শুধু একটা মাত্র কাজ, বিকালে সভায় যাওয়া। তখন স্বদেশি আন্দোলনের যুগ। মাদারীপুরের পূর্ণ দাস তখন ইংরেজের আতঙ্ক। স্বদেশি আন্দোলন তখন মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জের ঘরে ঘরে। আমার মনে হতো, মাদারীপুরে সুভাষ বোসের দলই শক্তিশালী ছিল। পনেরো-ষোল বছরের ছেলেদের স্বদেশিরা দলে ভেড়াত। আমাকে রোজ সভায় বসে থাকতে দেখে আমার ওপর কিছু যুবকের নজর পড়ল। ইংরেজদের বিরুদ্ধেও আমার মনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হলো। ইংরেজদের এদেশে থাকার অধিকার নেই। স্বাধীনতা আনতে হবে। আমিও সুভাষ বাবুর ভক্ত হয়ে পড়লাম। এই সভায় যোগদান করতে মাঝে মাঝে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর যাওয়া-আসা করতাম। আর স্বদেশি আন্দোলনের লোকদের সাথেই মেলামেশা করতাম।৭

তখন বঙ্গবন্ধুর বয়স পনেরো-ষোলো বছর। সেই সময়েই তাঁর মধ্যে জন্ম নেয় অসামান্য এক জীবনাকাক্সক্ষা আর তা হলো এই দেশ শাসন করার কোনো অধিকার ইংরেজদের নেই। তাদের এদেশ থেকে তাড়াতে হবে। সুতরাং স্পষ্টতই অনুধাবন করা যায় যে, খুব শৈশব থেকেই বঙ্গবন্ধুর ওপর এই নিয়তি ঠিক হয়ে যায়, রাজনীতি ছাড়া তাঁর আর কোনো ভবিতব্য নেই। আর সে জন্য অবশ্যই তাঁকে যেতে হবে কলকাতায়। কারণ কলকাতা ছাড়া ভারতবর্ষের আর কোন শহর তাঁকে গড়ে তুলবে? কোন শহরে তিনি উজাড় করে নিজেকে মেলে ধরতে পারবেন? এত বড় মানুষ তৈরি করার জন্য তখন ভূ-ভারতে আর কোনো শহর ছিল না। সুতরাং কলকাতাই তার নিয়তি। তাঁর নিরন্তর পূর্বপুরুষগণ কলকাতাকেন্দ্রিক যে জীবনযাপন করে গেছেন তা যেন এই ক্ষণজন্মা মানুষটির গড়ে ওঠার ভিত্তিভূমির এক বিপুল মহড়া। শেখ মুজিবের পুরুষানুক্রমে এই শহর যেন তাঁকে ধারণ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

চার.

১৯৩৭ সালে তিনি আবার লেখাপড়া শুরু করেন। পুরোনো স্কুলে নয়। তাঁকে ভর্তি করতে হবে নতুন স্কুলে। কারণ, পুরোনো স্কুলের সহপাঠীরা তাঁকে ডিঙিয়ে অনেক ক্লাস ওপরে উঠে গেছে। পরিচিত ছোটদের সঙ্গে তিনি পড়বেন না। সুতরাং তাঁকে ভর্তি করা হলো গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে। বাসায় তাঁকে পড়াতেন কাজী আবদুল হামিদ এমএসসি। এই শিক্ষক গোপালগঞ্জে ‘মুসলিম সেবা সমিতি’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের পক্ষে শেখ মুজিব ও অন্যরা থলি নিয়ে মুসলমানদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুষ্টি ভিক্ষার চাল উঠাত এবং ওই চাল বিক্রি করে গরিব ছেলেদের বই কেনা ও পরীক্ষার খরচাদির জোগান দেওয়া হতো। এ ছাড়া গ্রামে গ্রামে ঘুরে দরিদ্র ছেলেদের জায়গিরের ব্যবস্থা করে দেওয়াও ছিল এই সংগঠনের দায়িত্ব। শেখ মুজিব খুব উৎসাহের সঙ্গে এই সেবামূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেন। যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে হঠাৎ শিক্ষক আবদুল হামিদ মারা গেলে সংগঠনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন শেখ মুজিব। তরুণ শেখ মুজিব ছিলেন ওই সংগঠনের সম্পাদক। “যদি কোনো মুসলমান চাল না দিত আমরা দলবল নিয়ে তার ওপর জোর করতাম। দরকার হলে তার বাড়িতে রাতে ইট মারা হতো। এজন্য আমার আব্বার কাছে অনেক সময় শাস্তি পেতে হতো। আমার আব্বা আমাকে বাধা দিতেন না।”৮ তারুণ্যের খুব সহজ-স্বাভাবিক স্বীকারোক্তি। তাঁর এই সেবার পরিধি আরও অনেক বিস্তৃত ছিল। সমগ্র মহকুমায় যারা ভালো ফুটবল খেলত তাদের খুঁজে এনে তিনি মিশন স্কুলে ভর্তি করে দিতেন এবং বেতন মওকুফ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করতেন। শেখ হাসিনা লিখেছেন:

তিনি [শেখ মুজিবুর রহমান] ছোটবেলা থেকে অত্যন্ত হৃদয়বান ছিলেন। তখনকার দিনে ছেলেদের পড়াশোনার তেমন সুযোগ ছিল না। অনেকে বিভিন্ন বাড়িতে জায়গির থেকে পড়াশোনা করতো। চার-পাঁচ মাইল পথ হেঁটে স্কুলে আসতে হতো। সকালে ভাত খেয়ে স্কুলে আসত। আর সারাদিন অভুক্ত অবস্থায় অনেক দূর হেঁটে তাদের ফিরতে হতো। যেহেতু আমাদের বাড়িটা ছিল ব্যাংক পাড়ায়, আব্বা তাদেরকে বাড়িতে নিয়ে আসতেন। স্কুল থেকে ফিরে দুধভাত খাবার অভ্যাস ছিল এবং সকলকে নিয়েই তিনি খাবার খেতেন। দাদির কাছে শুনেছি আব্বার জন্য মাসে কয়েকটা ছাতা কিনতে হতো কারণ আর কিছুই নয়। কোনো ছেলে গরিব, ছাতা কিনতে পারে না, দূরের পথ রোদ-বৃষ্টিতে কষ্ট হবে দেখে, তাদের ছাতা দিয়ে দিতেন। এমনকি পড়ার বইও মাঝে মাঝে দিয়ে আসতেন।

দাদির কাছে গল্প শুনেছি, যখন ছুটির সময় হতো তখন দাদি আমগাছের নিচে এসে দাঁড়াতেন। খোকা আসবে দূর থেকে রাস্তার ওপর নজর রাখতেন। একদিন দেখেন তার খোকা গায়ের চাদর জড়িয়ে হেঁটে আসছে, পরনের পাজামা-পাঞ্জাবি নেই। কি ব্যাপার? এক গরিব ছেলেকে তার শত ছিন্ন কাপড় দেখে সব দিয়ে এসেছে।৯

খুব শৈশব থেকেই বঙ্গবন্ধুর মনোগড়নে গড়পড়তা মানুষের চেয়ে কিছু আলাদা বিষয় পরিলক্ষিত হয়। তিনি প্রচণ্ড সংবেদনশীল, হৃদয়বান, মানুষের অধিকারের প্রতি সচেতন, দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের প্রতি দয়ার্দ্র, নিজের পড়াশোনার বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন না হলেও সামগ্রিকভাবে শিক্ষার বিকাশে ও শিক্ষার অধিকারের বিষয়ে সোচ্চার, সংগঠনমুখী, রাজনীতিমনস্ক এবং জেদি, বলা যায় একরোখা। মনস্তত্ত্ববিদগণ মনে করেন সম্ভবত আটটি প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে মানুষের মধ্যে সেবার মনোবৃত্তি তৈরি হয়। এগুলো হলো: প্রয়োজন সম্পর্কে সচেতনতা (awareness of need), কারো আবেদন বা অনুনয় (solicitation), লাভ-ক্ষতির ধারণা (costs and benefits), পরার্থপরতা (altruism), খ্যাতি বা পরিচিতি (reputation), মনস্তাত্ত্বিক উপকারিতা (psychological benefits), মূল্যবোধ (values) এবং যোগ্যতা (efficacy)। ১০ বঙ্গবন্ধুর শৈশব থেকে বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ার দিকে তাকালে তাঁর স্বভাবের মধ্যে উল্লিখিত প্রবণতাগুলো লক্ষ করা যায়। এবং মানবীয় এই গুণাবলি সবচেয়ে লক্ষযোগ্য বিকাশ সাধিত হয় তাঁর কলকাতা জীবনে। মনে হয়, এই শহরটি আধুনিক জীবনের সর্বময় বিকাশের আয়োজন নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনার জন্যই অপেক্ষায় ছিল। চিকিৎসার জন্য একাধিকবার তিনি কলকাতায় গিয়েছেন, কিন্তু কলকাতা শহর তখন তাঁর অধিকারের স্থান ছিল না। তিনি তখন অভ্যাগত অতিথির মতো যেতেন এবং আসতেন কিন্তু থাকতেন না। ফলে তখনো কলকাতার সঙ্গে তাঁর অধিকারের সম্পর্ক তৈরি হয়নি।

পাঁচ.

১৯৩৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবং শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ আসেন। বাংলার বিখ্যাত দুই নেতার গোপালগঞ্জে আসাকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের মধ্যে বিপুল আলোড়ন তৈরি হয়। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তৈরি করার দায়িত্ব পড়ে শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর। তিনি দলমত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তৈরি করেন। কিন্তু পরে দেখা গেল, কংগ্রেস নেতাদের নির্দেশে সনাতন ধর্মাবলম্বী সদস্যরা সরে পড়ছে। রাজনীতির জটিল হিসাব-নিকাশের সঙ্গে এই তাঁর প্রথম পরিচয় ঘটে। বলা যায় শুধু পরিচয় নয় জেলখাটার মতো তিক্ত অভিজ্ঞতাও তিনি লাভ করেন এই ঘটনারই পটভূমিতে। কিন্তু এই দুই নেতার আগমনে যে অর্জন তাঁর হয়েছে তার কোনো তুলনা চলে না। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন:

হক সাহেব ও শহীদ সাহেব এলেন, সভা হলো। এগজিবিশন উদ্বোধন করলেন। শান্তিপূর্ণভাবে সকল কিছু হয়ে গেল। হক সাহেব পাবলিক হল দেখতে গেলেন। আর শহীদ সাহেব গেলেন মিশন স্কুল দেখতে। আমি মিশন স্কুলের ছাত্র। তাই তাঁকে সংবর্ধনা দিলাম। তিনি স্কুল পরিদর্শন করে হাঁটতে হাঁটতে লঞ্চের দিকে চললেন, আমিও সাথে সাথে চললাম। তিনি ভাঙা ভাঙা বাংলায় আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করছিলেন, আর আমি উত্তর দিচ্ছিলাম। আমার দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার নাম এবং বাড়ি কোথায়। একজন সরকারি কর্মচারী আমার বংশের কথা বলে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি আমাকে ডেকে নিলেন খুব কাছে, আদর করলেন এবং বললেন, “তোমাদের এখানে মুসলমি লীগ করা হয় নাই?” বললাম, ‘‘কোনো প্রতিষ্ঠান নাই। মুসলিম লীগও নাই।” তিনি আর কিছুই বললেন না, শুধু নোটবুক বের করে আমার নাম ও ঠিকানা লিখে নিলেন। কিছুদিন পরে আমি একটা চিঠি পেলাম, তাতে তিনি আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছেন এবং লিখেছেন কলকাতা গেলে যেন তাঁর সঙ্গে দেখা করি। আমিও তাঁর চিঠির উত্তর দিলাম। এভাবে মাঝে মাঝে চিঠিও দিতাম।১১

বঙ্গবন্ধু ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মধ্যে আদান-প্রদানের ওই চিঠিগুলো সংরক্ষণ করা হয়নি। চিঠিগুলো থাকলে গুরু-শিষ্যের সম্পর্কের মাত্রা আরও ভালোভাবে অনুধাবন করা যেত। বঙ্গবন্ধুর উপরোক্ত বক্তব্যে লক্ষণীয়, “আমাকে তিনি কাছে ডেকে নিলেন” কিংবা “তিনি আমাকে কাছে ডেকে নিলেন” লেখেননি মুজিব। মুজিব লিখেছেন, “তিনি আমাকে ডেকে নিলেন খুব কাছে।” একটি মাত্র ছোট বাক্যের গড়নের ভেতরে তিনি পুড়ে দিয়েছেন ‘শহীদ সাহেবের সঙ্গে তাঁর আজন্মের সম্পর্কের উষ্ণতা। যতই দিন গিয়েছে, সময় যতই অতিবাহিত হয়েছে, এই মহামিলনের আত্মিক বন্ধন ততই উচ্চতায় উপনীত হয়েছে, গুরু-শিষ্যের সম্পর্কের সুতো মজবুত হয়েছে। স্থাপন হয়েছে কলকাতার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের মজবুত ভিত্তি। ইসলামিয়া কলেজে শেখ মুজিবের সহপাঠী বন্ধু কাজী আহমেদ কামাল লিখেছেন, “This is the first time Sheikh Mujib came into contact with him. Suhrawardy spotted him and realized that here was a political worker, young and courageous with tremendous drive and initiative.১২

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যারাই আলোচনা করেছেন, গবেষণা করছেন তাদের অনেকেই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে এই মিলনকে ‘মহামিলন’ বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ বঙ্গবন্ধুর জীবনে রাজনীতি যে অনিবার্য নিয়তি ছিল তার শুভক্ষণ রচিত হয়ে যায় ওই মহামিলনের ক্ষণ থেকে। এর মধ্যে যোগাযোগ হয়েছে, চিঠি লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে কলকাতায় তাঁর দেখা হয় ১৯৩৯ সালে। শেখ মুজিবের জীবনে রচিত হয় অন্য এক অধ্যায়।

বঙ্গবন্ধুর আরেক ‘আইডল’ ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক চিরস্মরণীয় কিংবদন্তি নেতা। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তিনি সেই উজ্জ্বল ও মহান ব্যক্তিত্ব যিনি ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার জন্য সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি ‘নেতাজি’ নামে সমধিক পরিচিত। সুভাষচন্দ্র পরপর দুবার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে আদর্শগত সংঘাত এবং কংগ্রেসের বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ নীতির প্রকাশ্য সমালোচনা ও বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করার জন্য তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়। সুভাষচন্দ্র মনে করতেন, মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলন ও সত্যাগ্রহ নীতি ভারতের স্বাধীনতা লাভের জন্য যথেষ্ট নয়। তিনি সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ^াসী ছিলেন এবং ওই পথই বেছে নিয়েছিলেন। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাঁকে এগারোবার কারারুদ্ধ করেছিল। কিন্তু কিছুতেই তাঁকে জব্দ করতে পারেনি। তাঁর বিখ্যাত উক্তি “তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো।” তরুণ শেখ মুজিব এই বিপ্লবী নেতার মতাদর্শের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। শামসুজ্জামান খান লিখেছেন:

[…] পিতার কর্মস্থল মাদারীপুর ইসলামিয়া হাইস্কুলে পড়বার সময়েই তিনি নেতাজি সুভাষ বসুর রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন এবং একই সাথে স্বদেশি আন্দোলন সম্পর্কে তার আগ্রহ লক্ষ করা যায়। তিনি তখন তের-চৌদ্দ বছরের কিশোর। নিজের লেখা স্মৃতিকথায় ওই সময়ে তিনি স্থানীয় একটি স্বদেশি গ্রুপের নেতাদের সংস্পর্শে আসেন এবং তাদের কথা ও কার্যধারা তাকে উদ্দীপ্ত করে বলে উল্লেখ করেছেন।১৩

আর এই চিরকালের বিপ্লবের প্রতীক, কিশোর শেখ মুজিবের কল্পনার নায়ক সুভাষ চন্দ্র বসুর সঙ্গে তাঁর দেখা হওয়ার তথ্য দিয়েছেন সেই সময়ের একজন পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি অজয় কুমার দে। ১৭ মার্চ, ২০১৯ সালে দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় হামিদ কায়সারের একটি নিবন্ধ মুদ্রিত হয়। ‘বাংলার আত্মপরিচয়ের ঠিকানা জানতে মুজিবকে বুকের ভেতর রাখা জরুরি’ শিরোনামের ওই লেখায় কায়সার অজয়কুমার দে’র স্মৃতি উল্লেখ করেছেন। অজয় কুমার লিখেছেন:

আমার স্মৃতি যদি ঠিকভাবে কাজ করে, তা হলে ১৯৩৪ বা ১৯৩৫ সালে হবে, যেহেতু আমি ডায়েরি রাখিনি, সুভাষচন্দ্র বসু, যিনি পরবর্তীতে নেতাজী সুভাষ নামে খ্যাত, তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের সবচেয়ে তিক্ত সমালোচক ও শত্রু, কতিপয় ধারায় গ্রেপ্তার হয়ে কলকাতা মেডিকেল কলেজে হেনরি মার্টিন ব্লকের একটি কেবিনে ভর্তি ছিলেন… আমার বিশেষ দায়িত্ব ছিল শ্রী বসুর সঙ্গে বহিরাগত কারও সাক্ষাৎ করতে না দেওয়া। তার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে থাকার খবর স্থানীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল এবং প্রতিদিনই আমাকে এ ধরনের সাক্ষাৎপ্রার্থীকে থামাতে হতো। একদিন সকাল দশটার দিকে একজন উঠতি বয়সের তরুণ শ্রী বসুর সঙ্গে সাক্ষাতের আবেদনপত্র পাঠায়। আমি হাসপাতালের বড় সিঁড়ির কাছে দক্ষিণ পাশে তার সঙ্গে দেখা করি। […] আমি এসে দেখলাম সেই যুবকের বয়স ১৬-১৭ বছর হতে পারে। সে সাধারণ জামা ও শার্ট পরিহিত ছিল। আমি তার নাম জিজ্ঞাসা করলাম। সে বলল তার নাম শেখ মুজিবুর রহমান, একটি স্কুলে ক্লাস নাইনে বা টেনে পড়ে। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম কেন সে শ্রী বসুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চায়। সে বলল শ্রী সুভাষ বসুর বীরত্বের সে একজন ভক্ত, অনুরাগী। যেহেতু এই ভারতীয় মহান নেতা মানুষের প্রতি কোনো ভেদাভেদ করে না, তাই সে তাকে শ্রদ্ধা জানাতে চায়। লেখাপড়ায় আরো মনোযোগ দেয়ার জন্য বন্ধুত্বপূর্ণ উপদেশ দিয়ে আমি তাকে ফিরে যেতে বললাম। আমার শুভেচ্ছা নিয়ে সে চলে গেল। […] কিছুদিন পর সুভাষচন্দ্র বসুর ৩৮/২ এলগিন রোডের বাড়িতে দর্শনার্থীদের শনাক্ত ও নজর রাখার কাজে আমাকে ডিউটি দেয়া হয়েছে। সুভাষ বসু তখন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। এখানেও শেখ মুজিবুর রহমান নামে যুবকের দেখা পেয়ে অবাক হলাম। যখন সে ৩৮/২ এলগিন রোডের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল তখন আমি তাকে অনুসরণ করে এলগিন রোড পোস্ট অফিস পর্যন্ত যাই এবং তাকে জিজ্ঞাসা করি এবার শ্রী বসুর সঙ্গে তার দেখা করার কারণ কি? সে সহজভাবে বলে, ‘সুভাষ বসুর রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে সম্পূর্ণ একাত্মতা গোষণা।’১৪

১৯৩৪ সালে যখন বঙ্গবন্ধু সপ্তম শ্রেণির ছাত্র তখন তিনি বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতায় গিয়েছিলেন এবং ১৯৩৬ সালে গ্লুকোমা রোগে আক্রান্ত হয়ে চোখের চিকিৎসার জন্য যখন কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন তখনো তিনি সপ্তম শ্রেণির ছাত্রই ছিলেন। কিন্তু কলকাতায় গিয়ে শ্রী বসুর সঙ্গে দেখা করেছেন বলে কোনো তথ্য অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে নেই। আর ওই সময়ে তিনি ‘নাইনে বা টেনে’ পড়তেন না। তিনি তখন পড়তেন সেভেনে। তবে নাইন-টেনে পড়তেন বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক। কেননা, অসুস্থতার জন্য তিনি প্রায় চার বছর স্কুলে যেতে পারেননি। সুতরাং ওই ঘটনার সত্যতার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই। কেননা সুভাষচন্দ্র বসুকে তিনি রাজনৈতিক ‘আইডল’ মনে করতেন এবং বঙ্গবন্ধু স্বভাবগত কারণেই যে তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন, তা খুবই স্বাভাবিক। এভাবে কলকাতার জীবনের সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক জীবন নিবিড়ভাবে জড়িয়ে যায়।

মাদারীপুরে তাঁর রাজনৈতিক ভাবনায় আরেক বিপ্লবী গভীরভাবে প্রভাব ফেলে ছিলেন। তিনি হলেন স্বদেশি আন্দোলনের বিখ্যাত নেতা পূর্ণচন্দ্র দাস। ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী অনেকের মতো তাঁকেও কারাগারে নিক্ষেপ করেছিল। তিনি জেল থেকে বের হওয়ার পর বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে ‘পূর্ণ অভিনন্দন’ শিরোনামের একটি কবিতায় তাঁকে মাদারীপুরের ‘মর্দ-বীর’ বলে উল্লেখ করেন। শামসুজ্জামান খান লিখেছেন:

কিশোর শেখ মুজিবের জীবনে এ ঘটনা দুভাবে প্রভাব ফেলেছিল বলে মনে হয়। এক. তার এলাকার বীর

নায়ক পূর্ণচন্দ্রের বিপ্লবী জীবন তার মধ্যে এক লোকাল প্রাইডের সৃষ্টি করেছিল; দুই. তাকে অভিনন্দন জানিয়ে কবিতা লিখেছিলেন তখনকার বিদ্রোহী তরুণদের আইডল কবি-বিদ্রোহী নজরুল। এই ঘটনাই কিশোর মুজিবকে উদ্দীপ্ত করার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু এতেই শেষ না, সেই কবিতাই ছিল পরবর্তীকালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবের সর্বশ্রেষ্ঠ সময়ের এক বীজমন্ত্র ‘জয় বাংলা’ (ভাঙার গান, ১৯২৪) শব্দের ব্যবহার। কিশোর মুজিবের মনের গহিনে কি সেই সময় থেকে সোচ্চার উচ্চারণে যথাসময়ে প্রকাশের জন্য উন্মুখ হয়েছিল নজরুলের সেই অমোঘ শব্দযুগল? নজরুলের ওই সময়ের অন্য কবিতায় ব্যবহৃত ‘বাংলাদেশ’ শব্দটিও কি চিরকালের জন্য তার অন্তরে মুদ্রিত হয়ে গিয়েছিল?১৫

স্পষ্টতই যে, স্কুলছাত্র থাকা অবস্থাই তাঁর মধ্যে রাজনীতিমনস্কতা তৈরি হয়। বোধের কোনো এক গোপন সংবেদনায় তিনি বুঝতে পারেন, মানুষের মুক্তির জন্য রাজনীতির ভেতর দিয়ে অগ্রসর হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। সুতরাং রাজনীতিই তাঁর নিয়তি হয়ে দাঁড়ায় এবং এই নিয়তি ফলিয়ে তোলার জন্য কলকাতার জীবন অনিবার্য ছিল এবং কলকাতা তাঁর রাজনৈতিক সমৃদ্ধির স্কুলে পরিণত হয়েছিল।

ছয়.

১৯৩৯ সালে কলকাতায় বেড়াতে যাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন বঙ্গবন্ধু এবং এ সময় তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দেখা করেন। গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছেন:

শেখ মুজিব যখন কলকাতায় যান, শহীদ সোহরাওয়ার্দী তখনো মন্ত্রী। তাঁর বাড়িতে গেলে দারোয়ান প্রথমে শেখ মুজিবকে ঢুকতে বাধা দিলে সোহরাওয়ার্দীর দেওয়া কার্ডটি দারোয়ানকে দেখালেন। কার্ড দেখে তাড়াতাড়ি তাঁকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কাছে। সোহরাওয়ার্দী বললেন, ‘ম্যাট্রিক তো পাস করে ফেলেছ, এখানেই কলেজে ভর্তি হও। আমার সঙ্গেও কাজ করো।’ এভাবেই নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্রলীগের প্রাদেশিক শাখায় কাজ শুরু করেন শেখ মুজিব।১৬

কলকাতায় শেখ মুজিবের জন্য রাজনীতির যে পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, তাকে সময়ের আশ্চর্য এক সন্ধিক্ষণ ও উর্বরভূমি বলা যায়। তিনি ভর্তি হয়েছেন ইসলামিয়া কলেজে, যে কলেজের সব ছাত্র মুসলমান এবং প্রায় সকল শিক্ষকও মুসলমান। তিনি সিট পেয়েছিলেন বেকার হোস্টেলে, যেটি ছিল ছাত্র-আন্দোলনের দুর্গ। এবং যে সময়ে তিনি ওই কলেজে অধ্যয়ন করছিলেন সে সময়টি ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের সবচেয়ে জমাট সময়। আর তিনি শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এমন এক ব্যক্তির যিনি বিস্ময়কর এক অভিজাত পরিবারের উত্তরসূরি, ধর্মীয় ও পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত আধুনিক মানুষ এবং পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নেতা। এই মানুষটির গণতন্ত্র চর্চা, মানবিকতাবোধ, দেশপ্রেম, ন্যায়নিষ্ঠা, শ্রমশীলতা এবং উদারতা প্রায় কিংবদন্তিতুল্য। ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’ অভিধায় পরিচিত মহাত্মা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শেখ মুজিবের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলন অগ্নিগিরির অগ্ন্যুৎপাতের সকল লক্ষণ যিনি জ্বলে উঠলে পুড়িয়ে ফেলতে পারেন অন্যায়, অবিচার, শোষণ-বঞ্চনা আর পরাধীনতার সকল নাগপাশ।

এই দ্রোহের আগুন তাঁর চেতনার মধ্যে জমা হয়েছিল উত্তরাধিকার সূত্রে। শেখ পরিবারের যে উত্তরাধিকার তিনি ধারণ করেছেন, সেই পরিবার নিঃস্ব হয়েছে ব্রিটিশবিরোধী বিচিত্র কর্মকাণ্ড ও সংক্ষোভ-সংক্ষুব্ধতার জন্য। ব্রিটিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে, তাদের অন্যায়-অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে এই ধনাঢ্য পরিবারটি যাদের “জমিদারির সাথে সাথে বিরাট ব্যবসাও ছিল”১৭ সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে। শেখ পরিবারের এক পূর্বপুরুষ কুদরতউল্লাহ বা কদু শেখ। তিনি কীভাবে মি. রাইন নামে এক ইংরেজকে শাস্তি দিয়েছিলেন তার বিবরণ দিয়েছেন শেখ মুজিব। তিনি অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে লিখেছেন:

খুলনা জেলার আলাইপুরে মি. রাইন নামে একজন ইংরেজ কুঠিয়াল সাহেব নীল চাষ করে এবং একটা কুঠি তৈরি করে। আজও সে কুঠিটা আছে। শেখদের নৌকার বহর ছিল। সেইসব নৌকায় মাল নিয়ে কলকাতায় যেত। মি. রাইন নৌকা আটক করে মাঝিদের দিয়ে কাজ করাত এবং অনেক দিন পর্যন্ত আটক রাখত। শুধু শেখদের নৌকাই নয় অনেকের নৌকাই আটক রাখত। কেউ বাধা দিলে অকথ্য অত্যাচার করত। তখনকার দিনে ইংরেজদের অত্যাচারের কাহিনি প্রায় সকলেরই জানা আছে। শেখরা তখনও দুর্বল হয়ে পড়েনি। রাইনের লোকদের সাথে কয়েক দফা দাঙ্গা-হাঙ্গামা হলো এবং কোর্টে মামলা হলো। মামলায় প্রমাণ হলো রাইন অন্যায় করেছে। কোর্ট শেখ কুদরতউল্লাহকে বলল, যত টাকা ক্ষতি হয়েছে জরিমানা করুন, রাইন দিতে বাধ্য। ওই যুগে এইভাবেই বিচার হতো। শেখ কুদরতউল্লাহ রাইনকে অপমান করার জন্য ‘আধা পয়সা’ জরিমানা করল। রাইন বলেছিল, “যত টাকা চান দিতে রাজি আছি, আমাকে অপমান করবেন না। তা হলে ইংরেজ সমাজ আমাকে গ্রহণ করবে না; কারণ ‘কালা আদমি’ আধা পয়সা জরিমানা করেছে।” কুদরতউল্লাহ শেখ উত্তর করেছিল বলে কথিত আছে, “টাকা আমি গুনি না, মেপে রাখি। টাকার আমার দরকার নেই। তুমি আমার লোকের ওপর অত্যাচার করেছ; আমি প্রতিশোধ নিলাম।”১৮

অনুরূপ আরও দুটি ঘটনার বিবরণ আছে অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে। এবং এই সব বিবরণের মধ্য দিয়ে একটি সত্যই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, উত্তরাধিকার সূত্রেই বঙ্গবন্ধুর মধ্যে বিপ্লবী চেতনার বীজ উপ্ত ছিল। তার একটি তারুণ্যসুলভ রূপ স্কুলজীবনে পরিলক্ষিত হয়। তাই মনে হয়, গোপালগঞ্জ শহরের কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তি তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমানকে এই বলে সাবধান করে দিয়েছিলেন যে, “আপনার ছেলে যা আরম্ভ করেছে তাতে তার জেল খাটতে হবে। তার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে, তাকে এখনই বাধা দেন।”১৯ পুত্রের প্রতি বিশ^াসী দূরদর্শী শেখ লুৎফর রহমান বলেছিলেন, “দেশের কাজ করছে, অন্যায় তো করছে না; যদি জেল খাটতে হয়, খাটবে; তাতে আমি দুঃখ পাব না। জীবনটা নষ্ট নাও তো হতে পারে, আমি ওর কাজে বাধা দিব না। আমার মনে হয়, পাকিস্তান না আনতে পারলে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না।”২০ শেষ পর্যন্ত তাঁর পিতার ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়েছে। পুত্রের জীবন ব্যর্থ হয়নি বরং সাফল্যের, মহিমার, গৌরবের অত্যুঙ্গ শিখরে আরোহণ করেছে। তিনি একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটিয়েছেন।

শেখ মুজিবের মধ্যে আমরা যে বিপ্লবী চেতনার উত্তরাধিকার লক্ষ করেছি, তা কোনো অবস্থাতেই ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবীদের মতো সশস্ত্র ছিল না কিংবা শ্রমিক শ্রেণির রাজত্ব কায়েম করার জন্য ধনিক শ্রেণিকে খতম করতে হবে এমন নয়। উপরন্তু হাজার বছর ধরে উপমহাদেশের মানুষের মধ্যে যে সহনশীলতা, মানবিকতাবোধ, আত্মীয়তান্ত্রিক জীবন জিজ্ঞাসা, ক্ষমা, মমত্ববোধ, পরদুঃখকাতরা, প্রকৃতিচেতনা, সহজ-সুন্দর জীবনের প্রতি তীব্র আকাক্সক্ষা এসবের এক মধুর সম্মিলন ঘটেছিল তাঁর চরিত্রে। সঙ্গে ছিল সত্য, ন্যায় ও সুন্দরের পক্ষে আপসহীন অবস্থান। ফলে তাঁর বিপ্লবী চেতনার সঙ্গে এমন এক মাহাত্ম্য জড়িয়েছিল যার সঙ্গে অন্য কারো তুলনা চলে না। কলকাতার জীবনে তাঁর এই মনোগড়ন পরিপুষ্টি লাভ করে, পূর্ণতা পায়। [অসমাপ্ত]

তথ্যসূত্র

১. অচেনা এই কলকাতা, রমাপদ চৌধুরী সম্পাদিত, (কলকাতা: সংবাদ প্রকাশন, ১৩৮৯), পৃ. ১৩

২. শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মীবনী, (ঢাকা: ইউপিএল, ২০১২), পৃ. ৩

৩. শেখ হাসিনা, শেখ মুজিব আমার পিতা, (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ ২০১৫, পঞ্চম মুদ্রণ ২০১৭), পৃ. ২৫

৪. শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, প্রাগুক্ত। পৃ. ৩

৫. শেখ হাসিনা, শেখ মুজিব আমার পিতা, প্রাগুক্ত। পৃ. ২৫

৬. শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, প্রাগুক্ত। পৃ. ৬

৭. শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, প্রাগুক্ত। পৃ. ৯

৮. শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, প্রাগুক্ত। পৃ. ১০

৯. শেখ হাসিনা, শেখ মুজিব আমার পিতা, প্রাগুক্ত। পৃ. ২৮

10. Bekkers, R. H. F. P., & Wiepking, P. (2011). A literature review of empirical studies of philanthropy: Eight mechanisms that drive charitable giving. Nonprofit and Voluntary Sector Quarterly,40, 924–973

১১. শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, প্রাগুক্ত। পৃ. ১১

12. Kazi Ahmed Kamal, Sheikh Mujibur Rahman and Birth of Bangladesh, (Academic Press and Publishers Library, Dhaka 2013, First Edition 1970. P. 6

১৩. শামসুজ্জামান খান, শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, (ঢাকা: কথাপ্রকাশ, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ২০১৯। পৃ. ১৮

১৪. উদ্ধৃত, বঙ্গবন্ধুর কলকাতা জয়, জয়দীপ দে সংকলিত, (ঢাকা: কবি প্রকাশনী, ২০২১), পৃ. ২২৯-২৩০

১৫. শামসুজ্জামান খান, শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, প্রাগুক্ত। পৃ. ১৮-১৯

১৬. ‘হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গুরু’, আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী, কালের কণ্ঠ, ২০ জানুয়ারি, ২০২০

১৭. শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, প্রাগুক্ত। পৃ. ৩

১৮. শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, প্রাগুক্ত। পৃ. ৩, ৪

১৯. শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, প্রাগুক্ত। পৃ. ২১

২০. শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, প্রাগুক্ত। পৃ. ২১-২২

লেখক: প্রাবন্ধিক, গবেষক ও শিশু সাহিত্যিক

Source: https://www.dhakatimes24.com/2021/08/17/226369/%E0%A6%AC%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A7%E0%A7%81%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A6%B2%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A6%BE-%E0%A6%9C%E0%A7%80%E0%A6%AC%E0%A6%A8