একদা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্যাস্ত হতো না। পৃথিবীর উভয় প্রান্তেই ছিল তার সাম্রাজ্য। কী যে ছিল তার দোর্দণ্ড প্রতাপ আর প্রতিপত্তি। ইতিহাসের পাতায় যৎসামান্য হলেও তার নজির এখনো মেলে। উপনিবেশের ডানার নিচে কত দেশ যে ছিল তার করায়ত্তে একালে আর তা গোনা হয় না। তবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র ছিল ভারতবর্ষের কলকাতা ও লন্ডন।
জানেন কি, সড়ক পথে ২০ হাজার ৩০০ মাইল দূরত্বে অবস্থিত এই দুই প্রাণকেন্দ্রের মাঝে এককালে বাস চলাচল করত! খুব বেশি বছর আগেও নয়। ভারত থেকে তখন বিদায় নিয়েছে ব্রিটিশ শক্তি। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে। এটাই ছিল পৃথিবীর দীর্ঘতম বাসরুট।
প্রায় ১৫ বার লন্ডন থেকে কলকাতা যাতায়াত করেছিল সেই ডাবল ডেকার বাস। পোশাকি নাম ‘অ্যালবার্ট’। আর চার বার লন্ডন থেকে কলকাতা হয়ে ছুটেছিল অস্ট্রেলিয়ার সিডনি। বিশ্বাস হয় না তো! কঠিন হলেও এটাই সত্যি। লন্ডনের ভিক্টোরিয়া কোচ স্টেশন থেকে ছাড়ত সেই বাস। কয়েক জন যাত্রীর সেই বাস ধরার ছবি এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। তার পরেই সামনে এল সেই পৃথিবীর দীর্ঘতম বাস রুটের ইতিহাস।
যাতায়াতের খরচ নেহাত কম ছিল না। কলকাতা থেকে লন্ডন যাওয়ার এক পথের ভাড়া ছিল তখন ৮৫ পাউন্ড। ভারতীয় মুদ্রায় ৭ হাজার ৮৮৯ টাকা। দোতলা বাসের একতলায় ছিল খাওয়ার জায়গা, পড়ার জায়গা। শোওয়ার জন্য ছিল বাঙ্ক। বাসের ভিতর গরম রাখার জন্য হিটারও ছিল। মূলত লন্ডন থেকে অষ্ট্রেলিয়ার সিডনিতে সস্তায় চলাচলের জন্য এই বাস সার্ভিস চালু হয়। এই বাসে করে যাত্রীরা সরাসরি কলকাতা যেতেন। তারপর তাদের জাহাজে করে সিডনি নিয়ে যাওয়া হত। সঙ্গে বাসটাও।
লন্ডন-কলকাতা বাস সার্ভিস নিয়ে ১৯৫৭ সালের ৩ আগস্ট নিউইয়র্ক টাইমসে ‘লন্ডন-কলকাতা বাস লন্ডনে ফিরল ২০ হাজার ৩ শ মাইল ঘুরে ঘুরে!’ শিরোনামে একটি বিশেষ প্রতিবেদন ছাপা হয়। প্রতিবেদনটি এখনো পত্রিকাটির আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে।
ছবি- নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত সেই প্রতিবেদন।
সেন্ট্রাল ওয়েস্টার্ন ডেইলি বলছে, ১৯৪৭ সালের তৈরি এলবিন ডবল ডেকার বাসটি ২১ বছর যাত্রী সেবা দেয়ার পর একটি দুর্ঘটনায় চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। তখন অল্প দামে সেটি কিনে নেন ব্রিটিশ পর্যটক অ্যান্ডি স্টুয়ার্ট। সময়টা ১৯৬৮ সালের মে। প্রথম তিনি এটাকে তার ভ্রাম্যমাণ ঘর হিসেবে ব্যবহারের চিন্তা করেন। ভেবেছিলেন, গাড়িটিতে গেরস্থালি জীবনের টুকিটাকি জিনিস নিয়ে পৃথিবীর ঘুরতে বেরিয়ে পড়বেন। পরে ভাবলেন, এতবড় বাসে চাইলেই কিছু যাত্রীও নেয়া যায়। তাতে দুই পয়সায় আয় হয়। যে ভাবনা সেই কাজ।
১৯৬৮ সালের অক্টোবরে ১৩ জনের সঙ্গে সেই বাসে চেপে তিনি সিডনি থেকে ভারত ঘুরে লন্ডন যান। পথের দূরত্ব ছিল ১৬ হাজার কিলোমিটার। সিডনির মার্টিন প্লেসের জিপিও থেকে ৮ অক্টোবর বাসটি ছাড়ে। লন্ডন পৌঁছয় ১৩২ দিন পর। ১৯৬৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। তার পরেও স্টুয়ার্ট ওই বাস নিয়ে নাকি ১৪ বার লন্ডন থেকে সিডনি গেছেন বলে শোনা যায়।
লন্ডন থেকে ‘অ্যালবার্ট’–এর কলকাতা আসতে সময় লাগত ৪৯ দিন। জার্মানি, অস্ট্রিয়া বা প্যারিস, ভেনিস হয়ে বেলগ্রেড, ইস্তানবুল, সামসুন, তাবরিজ, তেহরান, মাশেদ, হেরাট, কাবুল, পেশোয়ার, লাহোর হয়ে অমৃতসর দিয়ে ভারতে ঢুকত সেই বাস। ভারতের দিল্লি, আগ্রা, বারাণসীতে থেমে কলকাতা পৌঁছত। প্রায় দেড়শোরও বেশি সীমান্ত পেরোতে হত ‘অ্যালবার্ট’–কে। যদিও কখনোই নাকি চেকিং বা নজরদারিতে পড়তে হয়নি। কখনো সন্দেহও পড়েনি। যে সব দেশ পেরিয়ে আসত, সবার কাছে ‘বন্ধু–দূত’ বলেই পরিচিত ছিল বাসটি।
১৯৭৬ সালে ইরানে রাজনৈতিক উত্তেজনা দেখা দিলে এই সরাসরি বাস সার্ভিস বন্ধ করে দেয়া হয়। এলবার্ট বাসটিকে সিডনি নিয়ে যাওয়া হয়। বর্তমানে জন ও উইনি নামের দুই বন্ধু বিখ্যাত এ বাসটির মালিক। ২০১২ সালে তারা এক নিলামে বাসটি কিনে নেন।
সূত্র- আজকাল, সেন্ট্রাল ওয়েস্টার্ন ডেইলি।
Source: https://www.kalerkantho.com/online/miscellaneous/2020/07/01/929799