জীবনানন্দের খোঁজে: কলকাতার অলিগলি – Prothom Alo কলকাতা নিউজ April 29, 2020Rangan Chatterjee কলকাতায় প্রেম নাকি হেঁটে বেড়ায় মাইলের পর মাইল, মনের আনন্দে। ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২১ আগস্ট ২০১৫) লিখছেন, ‘কত অজানা মন্দিরের অলিগলি, গুরুদ্বারের শান্ত পাঁচিল অথবা গির্জার নিরালা সেমেট্রি কিংবা জুম্মা পীরের দরগা সাক্ষী থেকে যায় প্রেমের কলকাতার। ভালবাসার-মন্দবাসার কলকাতার। শহুরে হাওয়ায়, নীরব প্রেমের পথচলায় সঙ্গী হয় দূর থেকে ভেসে আসা আজানের সুর, কালীমন্দিরের আরতির ঘণ্টাধ্বনি যুগপতভাবে।’ এই কলকাতা শহরের বড় রাস্তা, অলিগলি আর ইতিহাসমাখা সব ভবনের দিকে তাকালে জীবনানন্দের কথা মনে পড়ে। ‘হাইড্র্যান্ট খুলে দিয়ে কুষ্ঠরোগী চেটে নেয় জলঅথবা সে হাইড্র্যান্ট হয়তো বা গিয়েছিল ফেঁসেএখন দুপুররাত নগরীতে দল বেঁধে নামেএকটি মোটরকার গাড়লের মতো গেলো কেশে।’কবিতাটি আওড়াতে আওড়াতে কলকাতা নিউমার্কেটের কাছে একটি গলির ভেতরে সত্যিই একটি হাইড্র্যান্ট চোখে পড়ে এবং সেখান থেকে অনবরত জল পড়ছিল ‘অথবা সে হাইড্র্যান্ড হয়তো বা গিয়েছিল ফেঁসে।’ নগরীতে দল বেঁধে নামে দুপুর রাত। মোটরকারেরা গাড়লের মতো কেশে চলে যায়। এই কবিতায় পরবর্তী পঙ্ক্তিতে বলছেন:‘আমিও ফিয়ার লেন ছেড়ে দিয়ে—হঠকারিতায়মাইল মাইল পথ হেঁটে—দেয়ালের পাশেদাঁড়ালাম বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে গিয়ে—টেরিটিবাজারেচীনেবাদামের খোসার মতন বিশুষ্ক বাতাসে।’এই কবিতা পড়ি আর কলকাতা শহরের রাস্তায় হেঁটে বেড়াই এবং ফিয়ার লেন, টেরিটিবাজার বাজার, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট খুঁজি। তৎকালীন পূর্ববঙ্গের বরিশাল শহরে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা জীবনানন্দ বস্তুত নাগরিক মানুষ। নগরকে ভালোবেসেছেন, কিন্তু হৃদয়ে পুষে রেখেছেন বরিশাল, গ্রামবাংলা, কার্তিকের হিম, সোনালি ধান, যে কারণে সোমনাথ ও শ্রীমতী গল্পে (জীবনানন্দ রচনাবলি, ঐতিহ্য, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৩১) নায়কের মুখ থেকে নিজের মনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ: ‘কলকাতাকে ঘিরে একটা সমুদ্র থাকলে বেশ হত। বোশেখ মাসের রোদে যখন কলকাতার আকাশ ভরে যায়—আমার মনে হয় কাছেই সমুদ্র রয়েছে।’ এই গল্পে কলকাতা শহরের বর্ণনা: ‘ধর্মতলা বউবাজারের উত্তরদিকে টালা বাজার পর্যন্ত যে কলকাতা গিয়েছে, এটা সে কলকাতা নয়—চৌরঙ্গীর কলকাতাও নয়—এটা কালীঘাট পেরিয়ে ঢাকুরিয়া টালিগঞ্জ যাদবপুর বালিগঞ্জের এলাকায়। সোমনাথ বারো বছর আগে কলকাতায় এসেছিল মেছোবাজারে ঝামাপুকুর লেনে আরো কোথায় কোথায় যেন—ওইদিকে। মাঝে মাঝে সে চৌরঙ্গি অব্দি বেরিয়ে আসত বটে, তারপরে জগুবাবুর বাজারের চেহারা পর্যন্ত তার চেনা ছিল—এর পরবর্তী কলকাতা সম্পর্কে তার কোনো কৌতূহল ছিল না। এবার ভালো করে দেখেছিল সব ঘুরে ঘুরে। রসা রোড—টালিগঞ্জের দিকে চলে গিয়েছে—ট্রামে যাওয়া যায়—হেঁটে যাওয়া যায়—ট্রামে খানিকদূর গিয়ে তারপরে হেঁটে চলার ভিতরেই মন নাড়া পেয়ে খুশি হয়ে ওঠে। এদিকে রাসবিহারী এভিনিউ—বালিগঞ্জ স্টেশন যাদবপুর—আবার ফিরে এসে সাদার্ন এভিনিউ—এই পথ ধরে আবার ঘুরে টালিগঞ্জের এটুকু বর্ণনায় যেসব রাস্তাঘাটের কথা তিনি লিখেছেন, তাঁর সবই তাঁর নিজের জীবনী। বস্তুত জীবনানন্দের সব গল্প ও উপন্যাসের নায়ক তিনি নিজেই। এই গল্পের সোমনাথও তা-ই। ১৯৪৬ সালের ৮ জুলাই বরিশাল থেকে কলকাতায় যাওয়ার পর ছোট ভাই অশোকানন্দের বাসায় বসে গল্পটি লেখা। এখানে যেসব এলাকার কথা লিখেছেন, সেসব জায়গায়ই তিনি জীবনের কোনো না কোনো সময় কাটিয়েছেন। যেমন লিখেছেন, কলকাতায় প্রথম আসার পর সোমনাথ (মূলত জীবনানন্দ) মেছোবাজারে ঝামাপুকুর লেনে আরও কোথায় কোথায় যেন—ওই দিকে। বস্তুত তিনি কলকাতায় গিয়ে যখন প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন, তখন মেছোবাজারের দিকে, অক্সফোর্ড মিশন হোস্টেল, পরে বেচ্যু চ্যাটার্জি স্ট্রিট এবং ওই এলাকার একাধিক বাসা ও মেসে ছিলেন। এরপর যে জগুবাবুর বাজারের কথা লিখেছেন, সেখানের একটি স্কুলের চিলেকোঠায় থাকতেন তাঁর শেষ জীবনের শিষ্য ‘ময়ূখ’ পত্রিকার তরুণেরা। যে রসা রোডের কথা লিখেছেন, সেই রোডে ‘মোহিনী ম্যানশন’ নামে একটি বাড়িতে বিয়ের পর কিছুদিন ছিলেন ছোট ভাই অশোকানন্দ দাশ। সেই বাড়িতে জীবনানন্দও গিয়েছেন। রাসবিহারী অ্যাভিনিউ, বালিগঞ্জ স্টেশন, যাদবপুর, আবার ফিরে এসে সাদার্ন অ্যাভিনিউর যে কথা লিখেছেন, এটিই ছিল তাঁর সান্ধ্যকালীন হাঁটার পথ। গল্পটি ১৯৪৬ সালে লেখা হলেও এর আরও বেশ কয়েক বছর পর ডায়াবেটিসের কারণে যখন সন্ধ্যায় হাঁটা নিয়মিত রুটিনে পরিণত হয়, তখন এই পথেই হাঁটতেন। কলকাতা শহরের যেসব সড়ক, অলিগলি ও মহল্লা জীবনানন্দের নামের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে যায়, তার মধ্যে একটি হ্যারিসন রোড। বর্তমান নাম মহাত্মা গান্ধী (এমজি) সড়ক। এই হ্যারিসন রোডের ৬৬ নম্বর ভবনে প্রেসিডেন্সি বোর্ডিংয়ে কেটেছে তাঁর জীবনের মূল্যবান অনেক সময়। বিশেষ করে ১৯৪৬ সালে বরিশাল থেকে পাকাপাকিভাবে কলকাতায় এসে ১৮৩ ল্যান্সডাউন রোডের বাসায় ওঠার আগ পর্যন্ত। আবার এই হ্যারিসন রোডের ৯০/২/এ ঠিকানা থেকে বের হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরাপালক’; প্রকাশ করেছিলেন সুধীরচন্দ্র সরকার। বইটি জীবনানন্দের নিজের উদ্যোগে প্রকাশিত হলেও একজন প্রকাশকের নাম-ঠিকানা থাকতে হয় বলে ওই ঠিকানা ও প্রকাশক হিসেবে সুধীরচন্দ্রের নামটি ব্যবহার করেছিলেন। বইটি ছাপা হয়েছিল ২৯ কালীদাস সিংহ লেনে ফিনিক্স প্রিন্টিং ওয়ার্কস থেকে। এরপর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ধূসর পাণ্ডুলপি’ প্রথম ছাপা হয় ৫ ও ৬ চিন্তামনি দাস লেনে শ্রীগৌরাঙ্গ প্রেস থেকে। ‘বনলতা সেন’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪২ সালের ডিসেম্বরে ২০২ রাসবিহারী অ্যাভিনিউ, অর্থাৎ বুদ্ধদেব বসুর বাসভবন কবিতা ভবনের ঠিকানায়। ১৯৪৫ সালে বনলতা সেনের পরিমার্জিত সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১০/২ এলগিন রোডে সিগনেট প্রেস থেকে। এই এলগিন রোডেই শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতাল, জীবনানন্দ যেখানে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৪৪ সালে ‘মহাপৃথিবী’র প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় পূর্বাশা পত্রিকার অফিস পি ১৩ (পরবর্তীকালে ৫৪) গণেশচন্দ্র এভিনিউ থেকে। ফলে জীবনানন্দের ব্যক্তিজীবন নিয়ে কথা বললে এই সড়কগুলো নাম আসবেই। কলকাতা শহরের আরও কিছু জায়গার সঙ্গে জীবনানন্দের নাম যুক্ত। যেমন পটুয়াটোলা লেনে কল্লোল পত্রিকার অফিস। ১৯৪৯ সালের ২০ মে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তকে লেখা চিঠিতে (পত্রালাপ জীবনানন্দ দাশ, প্রভাতকুমার দাস সম্পাদিত, পৃষ্ঠা ১৭২) জীবনানন্দ জানান, কল্লোলের সেই ঘরে তিনি দু-চারবার নয়, দুই শবার গিয়েছেন। অচিন্ত্যও যে বিকেলের দিকে সেখানে আসতেন, তা-ও মনে করিয়ে দেন জীবনানন্দ। ৫৪ গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউতে ‘পূর্বাশা’ ও ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকার অফিস এবং সুহৃদ সঞ্জয়ের ডেরা বলে এই ভবনটি জীবনানন্দের যেমন প্রিয় ছিল, তেমনি এই সড়কের ৪৭ নম্বর বাড়িটাও উল্লেখযোগ্য তার ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র জন্য। কেননা, ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করেছিলেন সৌরেন্দ্রনাথ বসু। তাতে ঠিকানা লেখা নাভানা, ৪৭ গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউ। জীবদ্দশায় এটিই জীবনানন্দের শেষ প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশকাল ১৯৫৪ সালের মে। বইটির প্রচ্ছদ কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট, যেটি এখন বিধান সরণি, সেখানে ডি রতন নামে একটি ফটো স্টুডিওর সঙ্গেও জীবনানন্দের পরোক্ষ সম্পর্ক আছে। শোনা যায়, জীবনানন্দের যে পোর্ট্রেট ছবিটা তাঁর সব বইপত্র ও লেখালেখিতে পরবর্তীকালে ব্যবহৃত হতে থাকে, সেটি একটি গ্রুপ ছবি থেকে আলাদা করে এই স্টুডিও থেকেই প্রিন্ট করা হয়েছিল। যদিও এই স্টুডিওতে গিয়ে অনেক বিখ্যাত লোকের, এমনকি রবীন্দ্রনাথের ছবি চোখে পড়লেও জীবনানন্দকে পাওয়া গেল না। কলেজ স্ট্রিট মোড় থেকে উত্তর দিকের সড়কটিই বিধান সরণি। মেইন রোডের পাশেই রাস্তার পূর্ব দিকে চোখে পড়ে ডি রতন। সাইনবোর্ডে ইংরেজিতে লেখা: D Ratan & Co. An idial Photo taking studio since 1915. Digital Color Photo Lab. এখানে ঢুকতেই ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের কয়েকটি ছবি। সুভাষ বসুর কয়েকটি ছবিও চোখে পড়ে। পুরোনো আমলের দোতলা ছোট ভবনের নিচের তলায় ফটোকপির দোকান। দোতলায় মূল স্টুডিও।ডি রতনস স্টুডিও থেকে বের হয়ে আরেকটু উত্তরে গেলে চৌরাস্তা। সেটি পার হলেই হাতের ডানে ডিএম লাইব্রেরি। জীবনানন্দের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র প্রকাশক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ছাপা হয় এই লাইব্রেরির নাম। ১৯৩৬ সালের ডিসেম্বরে বইটি প্রকাশিত হয়। প্রিন্টার্স লাইনে লেখা ৪২ কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট। জীবনানন্দ তখন বিএম কলেজের শিক্ষক। বইটি উৎসর্গ করেন বন্ধু বুদ্ধদেব বসুকে। বইয়ের মুখপাতে ডিএম লাইব্রেরি লেখা থাকলেও আখ্যাপত্রে পেছনে প্রকাশক হিসেবে জীবনানন্দের নিজেরই নাম। জীবনানন্দ কলকাতা শহরকে নানাভাবে দেখেছেন। ‘ভিখিরি’ শিরোনামের একটি কবিতার শুরুটা এ রকম:‘একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি আহিরিটোলায়একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি বাদুড়বাগানে, একটি পয়সা যদি পাওয়া যায় আরো—তবে আমি হেঁটে চলে যাব মানে মানে।’ দুই লাইন পরে আবার লিখছেন:‘একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি মাঠকোটা ঘুরেএকটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি পাথুরিয়াঘাটা,একটি পয়সা যদি পাওয়া যায় আরো—তাহলে ঢেঁকির চাল হবে কলে ছাঁটা।’ কলকাতা শহরের একজন ভিখিরির এই একটি পয়সার প্রত্যাশাকে জীবনানন্দ কীভাবে দেখছেন? ক্লিন্টন বি সিলি (অনন্য জীবনানন্দ, পৃষ্ঠা ১৮৭) বলছেন, ‘এই মর্মভেদী ছোট কবিতাটা দিয়ে মানবতাবাদী জীবনানন্দকে সবচেয়ে ভালোভাবে দেখা যায়। তিনি ভিখারিদের দেখেন বাড়িয়ে দেওয়া হাত, চোখে পড়ার জন্য গলা লম্বা করে দিচ্ছে। অথচ তিনি কল্পনা করেছিলেন বনলতা সেনকে, আর এখন দেখছেন সত্যিকারের মানুষ।’ তিনি আহিরিটোলা, বাদুড়বাগান, পাথুরিয়াঘাটার কথা অপ্রাসঙ্গিকভাবে স্বগতোক্তির মতো মনে এল আর লিখলেন, ব্যাপারটা তেমন নয়। তার প্রতিটি স্থানের বর্ণনার পেছনে যুক্তি এবং কার্যকারণ সম্পর্ক রয়েছে। ক্লিন্টন মনে করেন, কলুটোলা পাথুরিয়াঘাটা, মির্জাপুর, এসপ্লানেড, মালাঙ্গা লেন, ক্রিক রো, ককবার্ন লেন, ফিয়ার লেন, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট, টেরিটিবাজার—সব জায়গা ও রাস্তা মিলে যে কলকাতার নগরচিত্র, জীবনানন্দ সেটিই আঁকেন। মৃত্যুর পর কলকাতা শহরের রবীন্দ্রসরোবর লেকের কাছে জীবনানন্দের নামে একটি সেতুর নামকরণও করা হয়েছে। একটি অপ্রকাশিত কবিতার শুরুটা এ রকম: ‘হঠাৎ তোমার সাথে কলকাতার সে এক সন্ধ্যায় উনিশশো চুয়াল্লিশে দেখা হল—কত লোক যায়ট্রাম বাস ট্যাক্সি মোটর জীপ হেঁকে যাদের হৃদয়ে কথা বেশি হাতে কাজ কম—তাদের অনেকেপায়ে হেঁটে চলে যায়।’বিনয় ঘোষ (কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত, পৃষ্ঠা ৫৭৯) জানাচ্ছেন, কলকাতা শহরের আধুনিক আঙ্গিক বিন্যাসের কাজ, অর্থাৎ পথঘাট ট্যাঙ্ক স্কয়ার ইত্যাদি তৈরি, মোটামুটি একটি পরিকল্পনা অনুযায়ী আরম্ভ হয় উনিশ শতকের গোড়া থেকে। তার আগে কলকাতার গ্রাম্য রূপই প্রায় অক্ষুণ্ন ছিল বলা চলে। উত্তর-মধ্য-দক্ষিণ কলকাতা ছিল কয়েকটি গ্রামের সমষ্টি মাত্র এবং সেই গ্রামের রূপ বাংলার যেকোনো সাধারণ গ্রামের মতোই ছিল। মাটি-খড়ের ঘর বা পর্ণকুটির, সাহেবেরা যাকে ‘নেটিভ হাট’ বলেছেন; মেঠো পথ, এঁদো পুকুর, পচা ডোবা, খাল-নালা, বাঁশবন-জঙ্গল ইত্যাদিতে ভর্তি ছিল গ্রামগুলো। মি. ঘোষ আরও লিখছেন, কলকাতা শহরের বহিরঙ্গের বিন্যাস আরম্ভ হয় উনিশ শতকের গোড়া থেকে এবং ওয়েলেসলি তার সূত্রপাত করেন।অতুল সুর (আমার দেখা কলকাতা, কলকাতা, পৃষ্ঠা ২১) তাঁর দেখা কলকাতার বিবরণে জানাচ্ছেন, ‘কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের একটা অপুর্ব সৌন্দর্য ছিল। রাস্তার ধারে প্রতি দশ-বিশ গজ অন্তর একটা করে কৃষ্ণচূড়া গাছ ছিল। যখন ফুল ফুটত, তখন দূর থেকে মনে হত, রাস্তার মাথা দিয়ে আগুনের ঢেউ ছুটে চলেছে।’ অতুল সুর আরও জানাচ্ছেন, তার ছেলেবেলায় কলকাতার বড় বড় রাস্তায় গ্যাসের আলো জ্বলত। কিন্তু গলি-ঘুঁজির ভেতরে কোনো কোনো জায়গায় তখনো তেলের আলোই ছিল। কলকাতার রাস্তায় প্রথম ইলেকট্রিক আলো জ্বলল বিশের দশকের মাঝখান থেকে। অর্থাৎ জীবনানন্দ তখন তরুণ এবং এই অধিকাংশ সময় এই শহরেই কাটাতেন।পুরোনো কলকাতার বর্ণনা দিতে গিয়ে রাধাপ্রসাদ গুপ্ত (কলকাতা বাঁচাও, কলকাতা, পৃষ্ঠা ৪৬) লিখেছেন, ‘তখন বড় বড় রাস্তা এমনকি অলিতে গলিতে হাইড্র্যান্ড ছিল। করপোরেশেনের রাস্তার জল দেওয়ার ওড়িয়া লোকেরা সেই হাইড্র্যান্টের মুখে লম্বা পাইপ লাগিয়ে অদ্ভুত কায়দায় রাস্তা ধুয়ে দিত। এই কায়দার আসল মজাটা বড় রাস্তায় না গেলে বোঝা যেত না। জলের ধারার সেই শোঁ শোঁ শব্দ—আমাদের ছোটবেলার এক অবিস্মরণীয় স্মৃতি।’ তবে কলকাতার সে হাইড্র্যান্টের গৌরব এখন আর নেই। অরুণ সেনের (বই পড়া বই পাড়া, কলকাতা, পৃষ্ঠা ৭৫) ভাষায়, ‘হয়তো হাইড্র্যান্টের পয়ঃপ্রণালীর প্রতিমাতেই কলকাতার নিঃসীম দুস্থতার যে ট্র্যাজিক ছবি, তা থেকেই আভাস পেতে পারে সমগ্রের লক্ষ্যও।’ প্রভাতকুমার দাস (জীবনানন্দ দাশ, তৃতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা ১৭) জানাচ্ছেন, জীবনানন্দ দাশ তাঁর জন্মস্থান বরিশাল শহর থেকে প্রথম কলকাতা শহরে আসেন ১০ বছর বয়সে, ১৯০৯ সালে। বাবা সত্যানন্দের অসুস্থতার জন্য সেবার মামাবাড়ির আত্মীয়দের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলেন গিরিডিতে। নতুন পরিবেশে খুব খুশি হয়েছিলেন। উশ্রী নদীর ওপারের ঝোলানো সেতু পার হয়ে বালুতটে শিশির ঝলমল হরিতকি বন ছাড়িয়ে ক্রিশ্চিয়ান হিল ছাড়িয়ে চলে যেতেন মামাতো ভাইবোনদের সঙ্গে। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে কলকাতায় আসা পড়াশোনার জন্য ১৯১৭ সালে; ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। তারপর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনেকটা সময় কাটিয়েছেন এই শহরের আলো-হাওয়ায়। এমনকি মৃত্যুর পর তাঁর ছাইভস্মও বিলীন হয়ে যায় এই শহরে।জীবনানন্দের ‘আবিষ্কারক’ বুদ্ধদেব বসুর জন্মও তৎকালীন পূর্ব বাংলায়। জীবনানন্দের সঙ্গে তাঁর একটি পার্থক্য, জীবনানন্দ বরিশাল শহর থেকে কলকাতায় গিয়েছেন, আর বুদ্ধদেব গিয়েছেন আরেকটি মহানগর ঢাকা থেকে। ফলে দুটি মহানগরীর পরিবর্তন ও তফাৎ খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে তাঁর। আত্মজীবনীতে (আত্মজৈবনিক, পৃষ্ঠা ১১৩) বুদ্ধদেব লিখেছেন: ‘একদিকে আমার সদ্য ছেড়ে আসা ঢাকার জীবন—যেখানে আমি জানি আর ফিরব না—অন্যদিকে এই নতুন পাওয়া কলকাতা, আমার ভবিষ্যৎ। একটা ফুরিয়ে গিয়ে এরই মধ্যে পরিণত হচ্ছে স্মৃতিতে, অন্যটা বেড়ে উঠছে, জোরালো হচ্ছে, হাজার হাতে আমাকে টেনে নিচ্ছে নিজের মধ্যে। দুই অংশের রং আলাদা, কণ্ঠস্বর আলাদা। একদিকে আমার যৌবনস্বপ্নে সবুজ হয়ে আছে রমনা, হাওয়ায়-হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে গানের কলি, কবিতার টুকরো—রবীন্দ্রনাথের অস্পষ্ট মদির “কী জানি কী”র অনুরণনে আমি কাঁপছি। আর কলকাতার প্রধান রং অ্যাসফল্টের ধূসর, প্রধান শব্দ ট্রাফিকের চিৎকার; এখানে গতি তীব্র, সংঘর্ষ অনেক, চাঞ্চল্য অবিরাম।’ যদিও এখন ট্রাফিকের চিৎকার, গতি আর চাঞ্চল্যে কলকাতার চেয়ে ঢের ব্যস্ত ঢাকা শহর।একসময়ের গ্রামীণ কলকাতা যে ধীরে ধীরে শহর ও নগর হয়ে ওঠে এবং এর আকাশ যে পাখিশূন্য হয়ে যায়, তাতে জীবনানন্দও ব্যথিত হন:‘সারাদিন পাখিগুলো কোন আকাশ থেকে কোন আকাশে থাকে।শহর কলকাতার শহর যেন পাখিহীন হয়ে থাকে;…কলকাতা আমাদের এবং কলকাতাও পাখিদের।’সজল বন্দ্যোপাধ্যায়ের (জীবনানন্দর কোলকাতা, জীবনানন্দ স্মৃতি) ভাষায়, ‘কলকাতার গভীরে যে কলকাতা, যার মাথার উপরে স্কাইলাইট আর সেখানে আকাশে পাখিরা পরস্পর কথা বলে, সেই কলকাতাকেই জীবনানন্দ ভালোবেসেছেন। তারই অন্ধকারের স্তনের ভিতর যোনির ভিতরে অনন্ত মৃত্যুর মতো তিনি মিশে থাকতে চেয়েছেন। শরীরে তারই মাটির গন্ধ মেখে, জলের গন্ধ মেখে তিন মগ্ন হয়েছেন।’ Source: https://www.prothomalo.com/onnoalo/article/1653689/%E0%A6%9C%E0%A7%80%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%96%E0%A7%8B%E0%A6%81%E0%A6%9C%E0%A7%87-%E0%A6%95%E0%A6%B2%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%85%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A6%97%E0%A6%B2%E0%A6%BF